নিজস্ব প্রতিনিধি:
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডে (এলপিজিএল) ভোক্তার নামে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রিতে সিন্ডিকেট কারসাজিতে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। প্রতিটি সিলিন্ডার ৫৯১ টাকা হলেও গেটের বাহির হলেই হাতবদল হয়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায়। অভিযোগ উঠেছে, এলপিজিএলের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে এসব অনিয়ম চলে আসছে। কঠোর লকডাউনেও বন্ধ হয়নি ভোক্তা পর্যায়ে সিলিন্ডার সরবরাহ। মূলত বাজারে বেসরকারি পর্যায়ে এলপিজিএলের চেয়ে দাম প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। এ সুযোগে এলপিজিএলের সিলিন্ডার কম দামে কিনে বেশি দামে বাজারে বিক্রির সুযোগ নিচ্ছে সিন্ডিকেটগুলো। এলপিজিএল সূত্রে জানা গেছে, এলপিজিএল গেটে প্রতিদিন ভোক্তা পর্যায়ে দুইশ থেকে সাড়ে তিনশ সিলিন্ডার বিক্রি হয়। বর্তমানে ভোক্তাদের সাড়ে চার হাজার কার্ড রয়েছে। কার্ডের বিপরীতে মাসে দুইটি করে সিলিন্ডার পান এসব ভোক্তারা। সরকারি প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বছরে প্রায় ১৫ হাজার টন এলপি গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বাজারজাত করে আসছে। এতে প্রায় ১২ লক্ষ সিলিন্ডার বাজারজাত করে তারা। জানা যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডে উৎপাদিত গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করতো অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বিপিসি। চলতি বছরে সরকারি নির্দেশে এলপিজির (লিকুফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস) দাম নির্ধারণ করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আগে প্রতিটি সিলিন্ডার ৭০০ টাকা বিক্রি করে আসলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে যাওয়ায় বিপিসি প্রতি সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করে ৬০০ টাকা। কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্তে গত ১২ এপ্রিল প্রথমবারের মতো ভোক্তা পর্যায়ে সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার ৫৯১ টাকা খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে। কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৫৯১ টাকায় বিক্রির কথা থাকলেও খোদ এলপিজিএলের কার্যালয়ের গেটেই বিক্রি হচ্ছে ৮০০-৮৫০ টাকায়। অন্যদিকে বিইআরসি নির্দেশিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ১২ কেজি এলপিজির মূল্য হচ্ছে ৯২৮ টাকা।
সরেজমিনে গতকাল সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে দুইটা পর্যন্ত প্রায় দেড় ঘন্টা এলপিজিএল গেটে অবস্থান করে দেখা গেছে, সাধারণ কিছু ভোক্তা দুইটি করে খালি সিলিন্ডার দিয়ে এলপি গ্যাস নিচ্ছেন। আবার স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি সিলিন্ডার কেনাবেচার কাজ করেন। যাদের কার্ড আছে, তাদের কাছ থেকে প্রতি সিলিন্ডার একশ থেকে দেড়শ টাকা বেশি দিয়ে কিনে নেন তারা।
কয়েকজন গ্রাহকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একই পরিবারের অনেকে এনআইডি কার্ড দিয়ে এলপি গ্যাস নেওয়ার কার্ড বানিয়েছেন। একেক পরিবারে ৫-৭টি কার্ড রয়েছে। প্রতি কার্ডে দুইটি করে হলে প্রতিমাসে ১০-১৪টি সিলিন্ডার তুলতে পারেন তারা। তাদের পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় একটি কিংবা দুইটি রেখে অন্যগুলো গেটেই বিক্রি করে দেন। এসবের সাথে এলপিজিএলের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত।
নিয়ম অনুযায়ী, কার্ডধারীরা স্বশরীরে হাজির হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দিয়ে সিলিন্ডার নেন। নিরীহ ও সাধারণ কিছু ভোক্তার ক্ষেত্রে নিয়মটি কঠোরভাবে মানা হলেও সিন্ডিকেট কারসাজিতে জড়িতদের ক্ষেত্রে নিয়ম মানার প্রয়োজন হয় না। এ বিষয়ে গেটে অপেক্ষমান সাধারণ ভোক্তাদের কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি। দুপুরে ক্ষিপ্ত এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি সকাল ১০টায় কার্ড জমা দিয়েছি। এখন দেড়টা বাজছে, আমাদের কার্ডগুলো বের হয়নি। যারা ব্যবসা করেন তাদের কার্ড অল্প সময়ে বের হয়ে যায়।’
দুপুর দেড়টার দিকে দেখা যায়, এলপিজিএল থেকে বের হয়ে একত্রে বেশ কয়েকটি কার্ড সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদের দেয়া হচ্ছে। ঘটনাস্থলে এ ধরণের দুইজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের একজন নয়ন এলপিজিএলের ক্যাজুয়াল কর্মচারী। আরেকজন সাইফুল। সাইফুল যমুনা অয়েল কোম্পানিতে ঠিকাদার সরবরাহকৃত জেনারেল ওয়ার্কার হিসেবে চাকুরি করেন। যমুনা অয়েলে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, এলপিজিএল থেকে যমুনা অয়েল কোম্পানির ডিলারদের জন্য সরবরাহকৃত এলপিজির বিষয়টি তদারকি করার দায়িত্বে রয়েছেন সাইফুল। সাইফুলের বাড়ি পতেঙ্গা এলাকায়। তার চাচা যমুনা অয়েল সিবিএর সাবেক সভাপতি ছিলেন। ওই পরিচয়ে জেনারেল ওয়ার্কার হয়েও যমুনা অয়েলে দাপট রয়েছে সাইফুলের। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এলপিজিএলের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে ভোক্তাদের জন্য সরবরাহকৃত সিলিন্ডারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন সাইফুল। এলপিজিএল গেটে স্থানীয় ভোক্তা থেকে সবাই তাকে ‘সাইফুল ভাই’ হিসেবে চেনেন।
ঘটনাস্থলে দেখা গেছে, এলপিজিএলের বাইরে সকাল থেকে প্রায় শতাধিক খালি সিলিন্ডার নিয়ে অবস্থান নেয় একটি পিকআপ। দুপুর গড়ানোর সাথে সাথে খালি সিলিন্ডার পাল্টে গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার উঠছে পিকআপটিতে। সাইফুলসহ তিন সহযোগীর কাছে এজন্য রয়েছে অসংখ্য ভোক্তা কার্ড। একেকটি কার্ডের বিপরীতে ক্রমান্বয়ে দুইটি করে গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার এনে পিকআপটিতে বোঝাই করা হচ্ছে। একপর্যায়ে সাইফুলের কাছে জানতে চাইলে তিনি যমুনা অয়েলের কর্মচারী নন বলে দাবি করেন।
শুধু পিকআপটি নয়, বেশ কয়েকটি রিকশা ভ্যানে ১০-২৫টি করে খালি সিলিন্ডার নিয়ে অবস্থান করে আরও কয়েকজন। তারাও স্থানীয়। ভোক্তা কার্ড সংগ্রহ করে বেশি দামে সিলিন্ডার বেচাকেনা করেন তারা। তাদের একজনের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমি প্রতিদিন ২০-৪০টি সিলিন্ডার বেচাকেনা করি। কার্ডধারীদের কাছ থেকে একশ থেকে দেড়শ টাকা বাড়তি দিয়ে কিনে নিই। যেসব ডিলার কম সিলিন্ডার সরবরাহ পান, তারা গেট থেকে বেশি দামে কিনে নিয়ে যান। আজকে ৮০০-৮৫০ টাকা পর্যন্ত একেকটি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে।’
এ বিষয়ে এলপিজিএলের মহাব্যবস্থাপক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সাধারণ ভোক্তাদের নির্ধারিত কার্ডের বিপরীতে মাসে দুইটি সিলিন্ডার দেওয়া হয়। জাতীয় পরিচয় পত্র দিয়ে যে কেউ কার্ড বানাতে পারেন। পরিবারের পরিচয় পত্রধারী সবাই কার্ড বানাতে পারেন। কোন বাধ্যবাধকতা নেই। যাদের ৫টি কার্ড আছে, তারা মাসে ১০টি সিলিন্ডার পায়। দুইটি রেখে অন্যগুলো বিক্রি করে দেন। এগুলোতো আমরা দেখি না। আবার কিছু গরীব মানুষ আছেন, তারা কিনে অন্য লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়ে দুই-তিনশ টাকা লাভবান হন।’ তিনি বলেন, ‘ভোক্তাদের গ্যাস বিক্রির বিষয়টি যিনি তদারক করেন, তাকে কাল (আজ মঙ্গলবার) জানাবো। বিষয়টি এমডিকেও (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) জানাবো।’
জানতে চাইলে এলপি গ্যাস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু হানিফ বলেন, ‘ভোক্তাদের সুবিধার্থে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে সিলিন্ডার গ্যাস কোম্পানির গেট থেকে নির্ধারিত ৫৯১ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু ভোক্তার নামে কারসাজি করে কেউ ব্যবসা করলে, বেশি দামে বিক্রি করে থাকলে, বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখে বিপিসিকে অবহিত করবো। কোনভাবেই অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।’