নবীন ও তরুণ লেখকদের করণীয়

Daily Daily

Zakiganj

প্রকাশিত: ১০:২৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০২৩
একটি বই ছাপতে গেলে সাধারণত ৯/১০টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়।
১। প্রচ্ছদ
২। কম্পোজ বা কনভার্ট
৩। অলংকরণ (শিশুতোষ বই এবং ছড়ার বইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য)
৪। প্রুফ রিডিং ও সম্পাদনা
৫। সেটাপ, গেটাপ ও মেকাপ
৬। সিটিপি
৭। কাগজ ক্রয়
৮। ছাপা
৯। কভার লেমিনেশন ও কিরিচ
১০। বই বাাঁধাই
.
এই নয়/দশটি ধাপের প্রতিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর যেকোনো একটিতেও যদি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কোনো ধরনের অবহলা করা হয় তাহলে বইটি আশানুরূপ হবে না। এ ক্ষেত্রে বইয়ের লেখক এবং প্রকাশক উভয়কেই যত্নশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
.
প্রথমেই ধরা যাক প্রচ্ছদের ব্যাপারটি। অধিকাংশ নবীন লেখক প্রচ্ছদের ব্যাপারে থাকেন উদাসীন। তাছাড়া নিজের পকেটের টাকা বাঁচানোর তাগিদে (যারা নিজের টাকা দিয়ে বই করেন অথবা মুদ্রিত বইয়ের সিংহভাগ বই অগ্রিম ক্রয় করেন) অনেকেই প্রচ্ছদটি যাকে তাকে দিয়ে করাতে চান বা রাজি হয়ে যান। একজন প্রতিষ্ঠিত প্রচ্ছদ শিল্পীর প্রচ্ছদ সম্মানী থাকে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। তো লিখিয়েরা এমন একটা এমাউন্ট শুধুমাত্র প্রচ্ছদের জন্য ব্যয় করতে হয় এমনটা শুনলে আশাহত হন। কেউ কেউ বিশ্বাসও করতে চান না। দ্বিতীয় অপশন থাকে নতুন কোনো প্রচ্ছদ শিল্পীকে দিয়ে প্রচ্ছদ করানো। এক্ষেত্রেও এক বা দুই হাজার টাকা প্রচ্ছদ সম্মানী দিতেই হয়। এখানেও বেঁকে বসেন অনেক লেখক। তাদের বক্তব্য, আমরা এত বুঝি না। আপনি / আপনারা কোনোমতে একটা প্রচ্ছদ করে দিয়ে দিন। এরকম ক্ষেত্রে প্রফেশনাল প্রচ্ছদ শিল্পীকে দিয়ে না করিয়ে প্রকাশনাসংস্থায় কর্মরত কম্পিউটার অপারেটর বা গ্রাফিক্স ডিজাইনারকে দিয়েই (কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকাশক নিজেই) প্রচ্ছদ করাতে হয়। একটি বইয়ের মূল আকর্ষণই হচ্ছে প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদ যত আকর্ষণীয় হবে এবং যত মানসম্পন্ন হবে বইটি তত বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। তাই প্রচ্ছদ সম্মানীর বেলায় আপোষ করার ফলে বইয়ের গোড়ায় গলদ তৈরি হয়, যা শেষ পর্যন্ত আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
.
দ্বিতীয় ধাপে পাণ্ডুলিপি কম্পোজ বা কনভার্টের বিষয়টি বর্তমান সময়ের লেখকদের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন না। তাদের ধারণা, কম্পোজ তো করাই আছে। অর্থাৎ লেখা তো সৃষ্টিই হয়েছে মুঠোফোনে। তাহলে এই লেখা আর কম্পোজ করতে হবে কেন? মুঠোফোনের লেখাগুলো থাকে অভ্র ফন্টে যা বিজয় বাংলায় রূপান্তর করতে হয়। এখানেই দরকার হয় কনভার্টারের। মুঠোফোনে টাইপ করা লেখাগুলো কনভার্টার সফ্টোয়্যার দ্বারা কনভার্ট করার পর নানা ঝামেলা তৈরি হতে পারে। শুধুমাত্র এ কাজে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ ব্যক্তির পক্ষেই এটা সম্ভব। যাকে তাকে দিয়ে কনভার্ট করিয়ে নিলেই কাজটা হয়ে যায় না। অনেক লেখকই এ ব্যাপারে থাকেন উদাসীন। তাই বই বের হওয়ার পর সমালোচনার মুখোমুখি হন এবং আফসোস করেন।
.
শিশুতোষ বই অথবা ছড়ার বইয়ের ক্ষেত্রে লেখার সঙ্গে মিল রেখে অলংকরণ বা চিত্রাংকন করা একেবারে ফরজে আইন। কিন্তু এটাকে নফলের পর্যায়েও রাখতে চান না অনেকে। তারা মুস্তাহাব মনে করেন এ কাজটি। কারণ প্রফেশনাল চিত্রশিল্পীকে প্রতিটি চিত্রের জন্য যে হারে সম্মানী দিতে হয় তা শুনে অনেকে মাথায় হাত রাখেন। বিকল্প মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটের আশ্রয় নিতে পরামর্শ দেন। তাই মেকাপম্যান ইন্টারনেটে ঘেঁটে ঘেঁটে ছড়া বা গল্পের সঙ্গে মিল রেখে বহু কষ্টে কিছু অলংকরণ বসান যার অধিকাংশই লেখার থিমের সঙ্গে মানানসই হয় না। আর মানানসই হলেও সেই অলংকরণ ব্যবহারে তো কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন ঘটে। এককথায় জিনিসটা অবৈধ। ‘অলংকরণ সংগৃহীত’ বলে অনেকে পার পেতে চান যদিও কিন্তু তাতে করে বইয়ের মান কিন্তু ৭০% কমে যায় নিজস্ব অলংকরণ না থাকার ফলে।
.
প্রুফ রিডিং ও সম্পাদনা হলো বই ছাপানোর পূর্বে সবচেয়ে জরুরি কাজ যা লেখকের জন্য অধিক জরুরি। প্রকাশক এ কাজটি স্কিপ করে যেতে চাইলেও লেখকের উচিত যেকোনো মূল্যে প্রুফরিডিং ও সম্পাদনা করিয়ে নেওয়া। কিন্তু এখানেও দুঃখের বিষয়, টাকা বাঁচাতে লেখকগণ নিজেরাই এ ধাপটিকে স্কিপ করে যেতে চান। প্রুফ দেখার দায়িত্ব গ্রহণ করেন লেখক নিজেই। নিজের লেখা নিজেই যতটুকু পারেন সম্পাদনাও করেন। এতে করে পাণ্ডুলিপির যেই লাউ সেই কদুর মতো অবস্থা হয়। নিজের করা ভুলগুলোকে কখনোই ভুল মনে হয় না। তাই শেষ পর্যন্ত টাইপিংভুলগুলো সংশোধন করিয়ে বইয়ের ‘প্রুফ দেখা সম্পন্ন হয়েছে’ মর্মে ছাড়পত্র দেন লেখকরা।
.
বইয়ের সেটাপ, গেটাপ ও মেকাপের দায়ভার সাধারণত প্রকাশকের উপরই বর্তায়। তবে লেখকদের এ ব্যাপারেও সচেতন থাকা উচিত। প্রতিষ্ঠিত ও মানসম্মত প্রকাশনাসংস্থাগুলোর বইয়ের সেটাপ গেটাপ কী রকম হয় তার খোঁজ খবর রাখা উচিত। যেনতেন প্রকাশনাসংস্থা থেকে বই করালে অনেক সময় বইয়ের সেটাপ গেটাপ অসুন্দর হয়। তাই মানসম্পন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেই বই করানো দরকার।
.
সিটিপি জিনিসটা কী?
সিটিপি বা CTP এর মিনিং হলো Computer to Plate. কম্পিউটারে মেকাপ শেষ হওয়ার পর পেস্টিং করে প্লেটের উপযোগী ফাইল তৈরি করতে হয়। এ কাজটিও প্রকাশনাসংস্থার লোকেরাই করে থাকে। তাই লেখকগণ এ ধাপের বিষয়ে অনেক সময় অন্ধকারেই থাকেন।
.
কাগজ ক্রয়ের কাজটিও প্রকাশনাসংস্থাই করে থাকে। লেখক যদি নিজেই প্রকাশক হয়ে বই করেন তাহলে অন্যসকল কাজের মতো নিজেই কাগজ ক্রয় করবেন। কাগজের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড মান বজায় রাখা জরুরি। সাধারণত ৮০ গ্রাম অফসেট কাগজে বই ছাপা হয়। ইদানীং অফ হোয়াইট কালারের কাগজের ব্যবহার বাড়ছে। কেউ কেউ ১০০ গ্রাম কাগজও ব্যবহার করে থাকেন। বইয়ের কভার বইয়ের প্রকারভেদে ১৫০ / ১২০ গ্রাম আর্টপেপারে (গ্লোসি) অথবা ৩০০ গ্রাম আর্টকার্ডে করা হয়।
.
এই ৬/৭টি ধাপ শেষ হলে বই ছাপার জন্য প্রস্তুত হয় এবং ছাপাখানায় চলে যায়। ছাপার ক্ষেত্রেও কোয়ালিটি মেইনটেইন করা জরুরি। নিখুঁত ও ঝকঝকে ছাপার জন্য ভালো মেশিনে ভালো কালি দিয়ে ছাপাতে হয়।
.
বইয়ের কভার ছাপা হওয়ার পর লেমিনেশন করতে হয়। সাধারণত বইয়ের কভারগুলো ম্যাট লেমিনেশন হয়ে থাকে। কেউ কেউ গ্লোসি বা নরমাল লেমিনেশন করালে খুশি হন। কারণ গ্লোসি লেমিনেশনে চক চক করে। বইয়ের মান বাড়াতে অনেকে স্পট লেমিনেশন করেন। ক্ষেত্রবিশেষে এ্যাম্পুশ বা ফয়েলও করাতে হয়। পেপারব্যাক বইয়ের ক্ষেত্রে কিরিচ করাও জরুরি।
.
সবশেষে নিজের আকৃতি পেতে বইটি বাঁধাই ঘরে গিয়ে হাজির হয়। বাঁধাই ঘরের প্রথম কাজ হচ্ছে বইয়ের ফরমাগুলো ভাঁজ করা। ভাঁজ করা শেষ হলে সেলাই করতে হয়। সাধারণত হাত দিয়েই সেলাই করা হয়। কেউ কেউ মেশিনে সেলাই করান। সবার সেলাই মেশিন থাকে না। হার্ডকভার বইগুলোতে কী মানের বোর্ড ব্যবহার করা হবে তা প্রকাশক ঠিক করে দেন। সাধারণত লেখকরা এ বিষয়ে অবগত থাকনে না। বইয়ের মান বাড়ানোর জন্য শিক বাঁধাই করানো যায়। এক্ষেত্রে খরচ ও সময় বাড়ার কারণে অনেকেই এ বিষয়টি স্কিপ করে যান।
.
এতসব কাজ করতে স্বাভাবিকভাবে সময় লাগে। সময় নিয়েই তাই বই বের করা উচিত। কিন্তু তাড়াহুড়ো পার্টির লেখকরা এটা মানতে রাজি নন। তাদের কথা হচ্ছে ধুমধাড়াক্কা কাজ শেষ করতে হবে। বই হাতে আসবে, ফটোসেশন হবে। মোড়ক উন্মোচন হবে। ফেসবুক সয়লাব হয়ে যাবে নিজের বইয়ে! একটি বই করতে যেখানে একমাসের মতো সময় নেওয়া দরকার সেখানে বইমেলা উপলক্ষে একমাসের মধ্যেই একশ প্লাস বইয়ের চাপ নিতে হয় অনেক প্রকাশককে। এ কারণেই অনেক সময় লেজেগোবরে অবস্থা হয়। আবার অনেক সময় কোনোমতে টেনেটুনে যাত্রাপথ পাড়ি দিতে পারলেও লেখক-প্রকাশকের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়।
.
তাই অপেক্ষাকৃত নবীন ও তরুণ লেখকদের প্রতি আমার পরামর্শ, পর্যাপ্ত সময় নিয়ে নির্ধারিত ধাপগুলো অতিক্রম করে তবেই বই প্রকাশের দিকে পা বাড়ান। মনে রাখবেন, আপনি পৃথিবীতে বেশিদিন বেঁচে থাকবেন না; তবে আপনার বইটি বেঁচে থাকবে শত শত বছর।