ইবনে সিনা : সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন

Daily Daily

Zakiganj

প্রকাশিত: ১:৫৫ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৩, ২০২৩

তাঁর পুরো নাম আবু আলী হোসাইন ইবনে আবদুল্লাহ আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা। আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক ‘ইবনে সিনা’ হিসেবেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত। তবে শুধু চিকিৎসা শাস্ত্রই নয়, তিনি ইতিহাসের অন্যতম সেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকও। আনুমানিক ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে উজবেকিস্তানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে এই বিজ্ঞানীর জন্ম।

ছোটোবেলা থেকেই ইবনে সিনার মধ্যে লুকিয়ে ছিল অসামান্য মেধা ও প্রতিভা। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআনের ৩০ পারা মুখস্থ করে ফেলেন। আর মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রের পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এর পেছনে তাঁর তিনজন গৃহশিক্ষকের অবদান ছিল।  তাঁর এসব গৃহশিক্ষকদের মধ্যে  ইসমাইল সুফি ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহশাস্ত্র আর তাফসির শিক্ষা দিতেন। মাহমুদ মসসাহ শিক্ষা দিতেন গণিতশাস্ত্র এবং বিখ্যাত দার্শনিক আল না তেলি শিক্ষা দিতেন দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যামিতি, টলেমির আল মাজেস্ট, জাওয়াহির মানতিক প্রভৃতি। উস্তাদদের জ্ঞানের প্রায় পুরোটাই এক সময় চলে যায় ইবনে সিনার দখলে। এরপর ইবনে সিনা নিজেই উস্তাদ হয়ে যান। চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর মৌলিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটতে শুরু করে। তিনি এরিস্টটলের দর্শন সম্পূর্ণ ধাতস্থ করেছিলেন। তিনি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু এবং একজন সত্যিকারের পাঠক। বিভিন্ন সময় নতুন বই না পেয়ে আগের বইগুলোই আবার পড়তে শুরু করতেন। ধীরে ধীরে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীব্যাপী। বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে ছুটে আসত নতুন কিছু শেখার জন্য। তাই তরুণ বয়সেই উস্তাদ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। একসময় তিনি চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত বই নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। বলা হয়, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের তিনিই জনক।

ইবনে সিনা ছিলেন গ্রিক এরিস্টটলীয় দর্শন দ্বারা প্রভাবিত একজন দার্শনিক। ধারণা করা হয়, তিনি ৪৫০টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যার মধ্যে ১৫০টি দর্শনশাস্ত্রবিষয়ক এবং ৪০টি চিকিৎসাবিজ্ঞানবিষয়ক। তাঁর সর্বাধিক বিখ্যাত রচনাগুলো হলো কিতাবুশ শিফা— একটি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক বিশ্বকোষ। এবং কানুন ফিত-তিব— একটি চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক বিশ্বকোষ— যা বহু মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রামাণিক মেডিকেল পাঠ্যবই হয়ে ওঠে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আলকানুন ফিত-তিব আরব জগত হতে আনিত সর্বাধিক প্রভাবশালী গ্রন্থ। একে চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলা হয়। ইবনে সিনার কানুন সম্পর্কে অধ্যাপক হিট্রি বলেন, ‘কানুনের আরবি সংস্করণ ১৫৯৩ সালে রোমে প্রকাশিত হয়েছিল। এবং এটি একটি প্রারম্ভিক যুগের মুদ্রিত গ্রন্থ। আরবি চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার স্থান অদ্বিতীয়।’

চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর রচিত ১৬টি মৌলিক গ্রন্থের ১৫টিতে তিনি বিভিন্ন রোগের কারণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। হৃদরোগের কারণ হিসেবে তিনিই প্রথম মানুষের মানসিক অবস্থাকে (রোগ, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি) দায়ী করেন। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় তিনি মানসিক প্রশান্তির সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ হিসেবে বিভিন্ন লতা-গুল্ম ও অন্যান্য বস্তুর বিবরণ দেন। কিন্তু যে গ্রন্থের কারণে তিনি অমর হয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিদ হিসেবে— সেটির নাম কানুন ফিত-তিব। মানবসভ্যতায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এর চেয়ে প্রভাবশালী গ্রন্থ এখন পর্যন্ত আর দ্বিতীয়টি নেই। ৫ খণ্ডে এবং ৮০০ পরিচ্ছেদে সমাপ্ত এই চিকিৎসা বিশ্বকোষে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে যেন একসঙ্গে বেঁধে ফেলেছেন। কানুন ফিত-তিবের প্রথম খণ্ডে রয়েছে শরীরতত্ত্ব ও স্বাস্থ্যতত্ত্ব, দ্বিতীয় খণ্ডে ৭৫০টি গুল্ম, পানীজ ও খনিজ ওষুধের বর্ণনা। এজন্য তিনি গ্রিক, রোমান, চীনা এবং ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতির সারনির্যাস সংগ্রহ করেন। তৃতীয় খণ্ডে মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একাধিক রোগ এবং সেগুলোর উপসর্গ, নির্ণয়, পূর্বাভাস,  কারণতত্ত্ব নিয়ে তিনি বিশদ আলোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তিনি মাথা হতে শুরু করে ধীরে ধীরে চোখ, কান, নাক, মুখ, দাঁত এভাবে নিচের দিকে নেমে চতুর্থ খণ্ডে বিশেষ কিছু রোগ যেমন: জ্বর, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, ভয়, বেদনা, প্রদাহ, পচন, বসন্ত, যক্ষ্মা, হাড়ের ভাঙন বা স্থানচ্যুতি, বিষক্রিয়া, ফোঁড়া, ঘা, চুল-নখ-চামড়ার বিভিন্ন রোগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি সর্বশেষ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করেছেন বিভিন্ন রোগের ব্যবস্থাপত্র, বড়ি, পাউডার ও সিরাপসহ নানা প্রকারের ওষুধসামগ্রী।

ইবনে সিনা মাত্র ১৯ বছর বয়সে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, কাব্য, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হন। ২১ বছর বয়সে ‘আল মজমুয়া’ নামক একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন। শুধু গণিতশাস্ত্র ছাড়া প্রায় সব বিষয় লিপিবদ্ধ করেছিলেন ইবনে সিনা। অনেক দেশ ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিও ছিল সমৃদ্ধ। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরী খোয়ারিজমে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে পণ্ডিত আল বেরুনির সাক্ষাৎ হয়। আল বেরুনির উৎসাহ ছিল ভারতবর্ষ নিয়ে। কিন্তু ইবনে সিনা কখনো ভারত অভিমুখে আসেননি। তিনি যাত্রা করেছিলেন ভারতবর্ষের উল্টো দিকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে। তাঁর মূল উৎসাহও ছিল পশ্চিমের দিকে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইবনে সিনার চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত বইগুলো প্রাচ্যের সীমানা ছাড়িয়ে পাশ্চাত্য জগতে স্থায়ী অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিল। খোয়ারিজম শহর থেকে বিদায় নিয়ে তিনি রাজধানী শহর গুরুগঞ্জে উপস্থিত হন। এই শহরে ইবনে সিনা তাঁর জীবনের বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেন। এখানে অবস্থানকালেই চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ে তাঁর অমর গ্রন্থ ‘কানুন ফিত-তিব’ রচনা করেন।

নানা বিষয়ে পারদর্শী ইবনে সিনা তাঁর যৌবনের শুরুর দিকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে পারদর্শীতা অর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি চিকিৎসার মাধ্যমে দুঃস্থ মানবতার সেবা করার জন্য মনস্থির করেন। এজন্যে চিকিৎসা বিষয়ক যাবতীয় গ্রন্থ সংগ্রহ করে তিনি গবেষণা শুরু করেন। তিনি একজন খাঁটি মুসলিম ছিলেন। একজন খাঁটি মুসলিম কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেমন নিয়ম অনুযায়ী কাজ করেন তেমনিই আবার কামনা করে থাকেন। ইবনে সিনা কোনো বিষয়ে যখন বুঝতে পারতেন না তখন দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহপাকের সাহায্য চাইতেন। কান্নাকাটি করে বলতেন, ‘হে আল্লাহ তুমি আমার জ্ঞানের দরজাকে খুলে দাও।’ আল্লাহ পাক পরম দয়ালু। বান্দার কাতর আবেদন মঞ্জুর না করে থাকতে পারেন না। কাজেই ইবনে সিনার দোয়া কবুল হত। ইবনে সিনা যখন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তেন তখন অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো তাঁর মানসপটে স্বপ্নের মত ভাসতো। তাঁর জ্ঞানের দরজা খুলে যেত। ঘুম থেকে উঠে-তিনি-সমস্যার-সমাধান-করে-ফেলতেন।

একজন বিখ্যাত চিকিৎসক হিসেবে সর্বত্র তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি জটিল রোগের চিকিৎসায় সাফল্য লাভ করেন। বোখারায় তখন বাদশাহ ছিলেন নূহ বিন মনসুর। তিনি একবার এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসা জগতের চুনোপুটি থেকে শুরু করে রাঘব বোয়ালদের কেউই তাঁকে সুস্থ করে তুলতে পারছিলেন না। বাদশাহ ইবনে সিনার সুখ্যাতি শুনেছেন। তাই তাঁকে ডেকে পাঠালেন। ইবনে সিনা বাদশাহকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাঁর রোগ সম্পর্কে অবহিত হলেন। পরে মাত্র কয়েকদিনের চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। বাদশাহ ইবনে সিনার ওপর খুবই খুশি হলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী পেলে খুশি হবেন? ইবনে সিনা বললেন, ‘জাঁহাপনা, লাইব্রেরির বই-পুস্তক যদি আমাকে পাঠ করার সুযোগ দেন তবে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হব।’ বাদশাহ সে সুযোগ দিলেন। ইবনে সিনা লাইব্রেরির সব বই মুখস্থ করে ফেললেন।

একবার খোরাসান শহর থেকে ইরানে যাওয়ার পথে ইবনে সিনা তাঁর সমসাময়িক কবি ফেরদৌসীর জন্মস্থান বিখ্যাত তুস নগরী পরিদর্শন করেন। এখান থেকে তিনি ইরানের সুপ্রাচীন শহর হামাদানে গমন করেন। ঐশ্বর্যশালী এবং ঐতিহাসিক নগরী ছিল শহর হামাদান। তাই ভালো লেগে গিয়েছিল ইবনে সিনার। তিনি এই শহরে অনেকদিন ছিলেন। দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে তিনি একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এদিকে তাঁর বয়সও হয়েছিল অনেক। তাই তিনি মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি খুঁজছিলেন। আর এই হামাদান শহরই ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। তিনি এই শহরেই প্রশান্তি খুঁজে পান। এখানে তিনি ধীর-স্থির মনে চিন্তা করার সময় সুযোগ পান। হামাদানের সম্রাটও ইবনে সিনাকে সমাদরে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর থাকা-খাওয়া ও নিরাপদ চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনি তখন চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে স্বাধীন জীবিকা উপার্জন করতেন। সারাদিন চিকিৎসা পেশার পর রাতে তিনি অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। গম্ভীর মূর্তিতে বসে থাকা তাঁর স্বভাবে ছিল না। ইবনে সিনা ছিলেন একজন জ্ঞানপিপাসু এবং জ্ঞানচর্চাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। এ সময় একবার সম্রাট ইবনে সিনাকে তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার অনুরোধ করেন। চিকিৎসাসেবা প্রদানের কারণেই তাঁকে নেওয়ার ব্যাপারে সম্রাট মনস্থির করেন। নিজে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সম্রাটের অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করেতে পারেননি। ইসপাহানের সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে হামাদানের পথে রওয়ানা করেন। হামাদানের সঙ্গে ইবনে সিনার অনেক স্মৃতি জড়িত ছিল। আর এখানে এসেই তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর এই অসুখ আর সারেনি। হামাদানের যুদ্ধশিবিরে অবস্থানকালে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনা ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুন মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।

[তথ্যসূত্র : ইবন সিনা: সংক্ষিপ্ত জীবনী – সৈয়দ আবদুস সুলতান; ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের পক্ষে ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, রাজশাহী থেকে প্রকাশিত। প্রকাশক – মাসুদ আলী; প্রকাশকাল: জুন, ১৯৮১; পৃষ্ঠা ৬-৭; রাষ্ট্র দর্শনে মুসলিম মনীষা – আবু জাফর, প্রকাশক: অধ্যাপক শাহেদ আলী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৪৭।]