আনন্দ-তিক্ততার মিশেলে তাজমহল ও আজমীর ভ্রমণ

Daily Daily

Zakiganj

প্রকাশিত: ১১:১২ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২, ২০২৪

 

ছোট বেলার শখ ও ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে তীর্থ আজমের শহর ভারতের আজমীর শরীফ ও বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের মধ্যে এক এবং অন্যতম ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে খ্যাত ভারতের আগ্রার তাজমহল দেখতে যাব। আল্লাহর রহমতে গত বছর ২৭ জানুয়ারী তারিখে বাংলাদেশ থেকে জকিগঞ্জ সীমান্ত বর্ডার পার হয়ে নৌকাযোগে ভারতের করিমগঞ্জ গিয়ে
সেখান থেকে প্রথমে বাসে চড়ে শিলচর যাই। রাত ৮ টার দিকে শিলচর পৌছার পর পড়ি এক মহাবিপাকে। কোন হোস্টেলে আমাদেরকে থাকার সীট দেয়না। প্রথমে সীট দেয়ার জন্য খাতায় ডাটা এন্ট্রি করার পর যখন পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দেখে আমাদের ধর্মীয় পরিচয় মুসলিম তখন আর রুম দেয়না। কয়েকটি হোস্টেলে ঘুরলাম। একই অবস্থা। যাইহোক রাত ১২ টার দিকে এক পর্যায়ে একটি হোস্টেলে গিয়ে কাকুতি মিনতি করে ম্যানেজারের মন গলাতে সক্ষম হই। ম্যানেজার আমাদেরকে বললো ৩ হাজার রুপি দিলে একটি রুম দেবে। তার চাওয়া মত ৩ হাজার টাকা দিতে রাজী হলাম। একটি রুম দিলো আমাদেরকে খুবই নোংরা ও খারাপ। এরপরও তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ছাড়া টু শব্দ করার কোন সুযোগ নেই। খাবার হোটেলের অবস্থা খুবই করুন। নিম্নমানের খাবার প্রায় প্রতিটি হোটেলে। বড় বড় লম্বা লম্বা ভাত দেখেই ক্ষুদা মিটে যায়। এরপরও বাধ্য হয়ে একবার ভাত খেয়েছিলাম। এরপরই শরীরে দেখা দেয় সমস্যা। পেট খারাপ হয়ে যায়। তাৎক্ষণিক ঔষধ নির্ভর হয়ে পড়ি। ভোর বেলা বিমানযোগে কলকাতা যাবার লক্ষে শিলচর কুর্মিগ্রাম বিমানবন্দর যাবার সময় ক্ষুধার জ্বালায় রুটি খাই খুবই কষ্ট করে। রুটিগুলোও খুবই নিম্নমানের ময়দা দিয়ে বানানো। এরপরও করার কিছু নাই ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে হবে। কুর্মিগ্রাম বিমানবন্দর থেকে সাড়ে ৭টার দিকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে পড়ি জীবনের ঝুকিতে। হঠাৎ বিমানবালা জানায় আমাদের বিমানটি দূর্ঘটনার কাছাকাছি। জানালার কাচের দিকে তাকিয়ে দেখি জমাট বাঁধা মেঘের চাকা কেটে বিমান উপরে উঠতেছে আর দোলতেছে। যাত্রীদেরকে স্ব স্ব ধর্মীয় জিকির আযকার করতে বলা হয়। আমি তখন আমার পরিবার পরিজনের কথা স্মরণ করে দোয়া দুরুদ পড়তে থাকি। যাইহোক একটু পরে আল্লাহর রহমতে বিমানটি আশঙ্কামুক্ত হয়ে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কলকাতা গিয়ে পৌছি। এরপর সকাল ৯টার দিকে কলকাতা থেকে দিল্লির দিকে আবার বিমানযোগে রওয়ানা হই। সকাল ১১ টার দিকে গিয়ে পৌছি দিল্লি বিমানবন্দরে। দিল্লি থেকে বাসযোগে রওয়ান হই আগ্রার দিকে। নয়াদিল্লী নতুনত্বের আভিজাত্যে মোড়ানো। এবং পুরনো দিল্লী চমক জাগানিয়া ঘোড়ায় টানা গাড়ির টগবগানো খুড়ের আওয়াজে বাদশাহির কাল স্মরণে আনার মতন। তবে সেখানেও বিমানবন্দরের পাশে রেস্টুরেন্টে খাবারের বিড়ম্বনা। খাবার দিলে পানি দেয় না।

Taj Mahal Pictures | Freepik

দিল্লির মত বড় শহরে খাবারের বিড়ম্বনা দেখে খুবই খারাপ লেগেছে। দিল্লি থেকে ভালোবাসার তাজমহল দেখতে রওয়ানা হই আগ্রার দিকে। আগ্রায় যাবার সময় অবলোকন করেছি পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্য। মনে মনে ভাবলাম অপরূপ সৌন্দর্যের মোড়কে বিধাতা কেমনে গড়েছেন এ রঙের দুনিয়াকে। চারিদিকে সবুজের নান্দনিক সমারোহ। পাহাড় আর সবুজ এসে মিশে যায় আমাদের প্রাণের সবুজে। আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে যেন পাহাড় ঘুমায়। রাতের পাহাড় কী যে মনোরম তা না দেখলে বোঝানো যাবে না। চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখে মনে হয় ‘ধনধান্যে পুষ্পেভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’। রাতে গিয়ে পৌছি আগ্রায়। সেখানে যাবার পর তাজমহলের অদূরে একটি হোস্টেলে রুম ভাড়া করে রাত পোহাই। পরদিন ভোরে পাসপোর্ট দেখিয়ে জনপ্রতি টিকিট সংগ্রহ করে নিলাম। ভেতরে জুতো পায়ে প্রবেশ নিষেধ। এজন্য টিকিটের সাথে আমাদের দেওয়া হয়েছিল বিশেষ কাপড়ের জুতো। তা পরে নিয়ে ঢুকে গেলাম তাজমহলের একদম ভেতরে। নিরাপত্তা বেষ্টনি অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকতেই দূরে চোখে পড়লো তাজমহল। তাজমহলের চারদিকে রয়েছে কয়েকটি পুরনো ভবন। এগুলো নাকি সে সময় বিশ্রামাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তাজমহলের ভেতরে ছবি তুলতে নিষেধ আছে। এরপরও এত অপরূপ দৃশ্য দেখে ছবি তুলতে কার না মন চায়। আমিও একজন নিরাপত্তা কর্মীকে কিছু টাকা দিয়ে ছবি তুলে নিলাম। মধ্য দুপুরের রোদে চিকচিক করছিল পুরো তাজমহল। সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের সমাধি একদম তাজমহলের মাঝেই। ভেতরে বেশি সময় থাকার সুযোগ নেই। বাইরে এসেই দেখা মিললো তাজমহলের অপরূপ সৌন্দর্য। পাথর ও পাথর কেটে তৈরি করা টাইলস দিয়ে কিভাবে সেই সময়ে এমন একটি স্থাপনা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, সে চিন্তায় কেটে গেল অনেকটা সময়। তাজমহলে পাশ দিয়েই বয়ে গেছে যমুনা নদী। পাখিদের কাকলিতে মুখরিত হয়ে আছে প্রেমের অমর কথামালা। শুকনো মৌসুম হওয়ায় নদীতে হাঁটু পানি। নদীর ওপারে আগ্রা ফোর্ট। তাজমহলের নির্মাণশৈলী আমাকে মুগ্ধ করেছে। নিজ চোখে দেখে মনে হলো সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের অমর কীর্তি আর দ্বিতীয়টি আসলেই পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই অমর তাজমহল দেখার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন ভিড় জমান হাজার হাজার পর্যটক। আমিও হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে খুবই আনন্দ পেয়েছি। তাজমহলের নিদর্শনগুলো দেখে মনে হয়েছে সম্রাট শাহজাহান যেন এখন পর্যন্ত প্রেমের কথা বলতেছেন। তার প্রেমের অপরূপ দৃশ্য আমার হৃদয় কেড়ে নিয়েছে। তাজমহল দেখে মনে হচ্ছে, যে কেউ শুদ্ধ ভালবাসার উদাহরন দিতে গেলে তাজমহলের নামটি সবার আগে বলতে হবে। দুপুরের দিকে তাজমহল থেকে বেরিয়ে এসিবাস চড়ে তীর্থ আজমের শহর ভারতের আজমীর শরীফ দেখতে রওয়ানা হই। রাত ১১ টার দিকে গিয়ে পৌছি। আজমীর শরীফ যাবার পথে গাড়ী থেকে যেদিকে তাকাই সেদিকেই যেন সুন্দরের আগুন। সুন্দর দেখে চোখের পলক মারতে যেন ভূলে যাই। পাহাড় বেষ্টিত সড়ক। কোথাও পাহাড় কেটে রাস্তা আবার কোথাও পাহাড়ের নীচে ৮ মাইল, ৫ মাইল, ৩ মাইল সুড়ঙ্গ দিয়ে পৌছালাম আজমীর শরীফ। সেখানে গিয়ে আজমীর শরীফের একটু দূরে একটি হোটেলে উঠলাম। পরদিন সকালে একমাত্র সর্বধর্ম মিলনক্ষেত্র এই আজমীর শরীফে গিয়ে দেখি আজমীর শরীফ যেন আমাদের সিলেটের হযরত শাহজালাল র. এর দরগাহ শরীফের মত হিন্দু মুসলিমসহ সকল সম্প্রদায়ের কাছে মহান তীর্থস্থান।

Ajmer Sharif Dargah Mannat, Mannat Arrangements in Ajmer ...

হাজার হাজার ধর্মপ্রান মানুষের পদভারে মুখরিত মাজার এলাকা। শ্বেত মর্মরের সমাধিবেদী, রূপার রেলিং, সোনায় মোড়ানো সিলিং, রূপার পাতে মেড়ানো এর বুলুন্দ দরজা। আজমীর শরীফ জিয়ারত করলাম। ভিক্ষুকও অনেক। নারী ভিখেরী খুবই নাছোড় টাইপের। পথচলতি নারী ভিখেরী রীতিমত পিঠের পরে ঠোকনা মেরে বলতে থাকে – ‘দে দোনা দশ রুপিয়া’ ! বাংলাদেশেও প্রচুর ভিখেরীরা সবখানেই, তবু অমন নাছোড় ভিখেরী পিঠে ঠোকনা মারে তা দেখিনি কোথাও আর। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা বটে। যাই হোক, আজমীর শরীফ জিয়ারত করার পরে আমাদেরকে লাল-হলুদ সূতা এবং তবারুক দেওয়া হলো। বিশাল উঁচু সিঁড়ির মাথায় ওঠা ও দেখা বিশাল হাঁড়ি, যে হাঁড়িটিতে প্রতি বছর ওরসে আগত লক্ষ-লক্ষ মানুষদের তবারুক হিসেবে তেহারী চড়ানো হয়। সে নাকি অফুরান খাওয়া। যত লোকই হোক খাওয়া অফুরান আল্লাহ তায়ালার কুদরত আর কি ! আজমীর শরীফে আমাদেরকে বাড়তি আনন্দ দিয়েছে ঘোড়ার গাড়ি ও উটের বাহন। তখন মনে হয়েছে ভারতে ঘুরতে এসে পদচিহ্ন ছাড়া কিছু ফেলে আসবো না, ছবি আর স্মৃতি ছাড়া কিছু নিয়ে আসতে পারবো না।