যার অনুপ্রেরণায় আল কাসসাম ব্রিগেড

Daily Daily

Zakiganj

প্রকাশিত: ১২:৩৮ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২, ২০২৪

সময়টি উসমানিয় শাসন আমল।১৮৮২ সাল ১৯ ডিসেম্বর
সিরিয়ার উত্তর পশ্চিমে জাবলাহ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন মুসলিম উম্মাহর এক মহাবীর মুজাহিদদের অনুপ্রেরণার বাতিঘর।বর্তমানে হামাসের সামরিক শাখার নাম “আল কাসসাম ব্রিগেড” যার স্বরণে নামকরণ করা হয় তিনি হলেন ইজ্জউদ্দিন আবদুল কাদির ইবনে মুস্তাফা ইবনে ইউসুফ ইবনে মুহাম্মদ আল-কাসসাম। সংক্ষেপে ইজ্জউদ্দিন আল-কাসসাম।

সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ-
শহীদ আল-কাসসাম রহ.এর পিতা আবদুল কাদির ছিলেন উসমানীয় যুগে শরিয়া আদালতের একজন কর্মকর্তা।
আল কাসসাম প্রকৃত ফিলিস্তিনি নন। তিনি ছিলেন সিরিয়ার মানুষ।স্থানীয় ইস্তাম্বুলি মসজিদে খ্যাতনামা আলেম শাইখ সালিম তাইয়ারাহর (রহ) এর তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া করেছেন।
১৯০২ থেকে ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আল-কাসসাম(রহ) আল-আজহার মসজিদে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে কায়রো গমন করেন। সেখানে তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন বিখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত জামাল আল দ্বীন আফগানী(রহ) প্রধান অনুসারী মুহাম্মদ আবদুহুর (রহ) সাথে। আল আজহার ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালে আল-কাসসাম(রহ)সুফিবাদের সাথে জিহাদী চেতনায় উজ্জীবিত হন।
ইসরাঈল রাষ্ট্র গঠনের প্রাক্কালে ইহুদীবাদ ও ব্রিটিশদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেন।

পেশা ও শরিয়াহ আন্দোলনঃ-

১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আলেম হিসেবে জন্মস্থান জাবলাহ ফিরে আসেন এবং মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি কাদেরিয়া তরিকা এবং কুরআনের আইনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা শিক্ষা দিতেন। শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি ইবরাহিম ইবনে আদহাম(রহ) মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জাবলাহতে ফিরে এসে আল-কাসসাম রহ. জামালুদ্দিন আফগানী(রহ) ধারণা অনুসারে নৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে ইসলামি পুনর্জা‌গরণ কর্মসূচি শুরু করেন। মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও ফরজিয়াত পালনের ব্যাপারে তিনি তাকিদ করেন। নিয়মিত নামাজ ও রোজা পালন এবং জুয়া ও মদ্যপান বন্ধ করাও তার কার্যক্রমের অংশ ছিল। আল-কাসসামের কার্যক্রম জাবলাহতে প্রভাব ফেলে এবং স্থানীয় জনগণ তার সংস্কার গ্রহণ করে। তখন আরবদের মধ্যে গড়ে ওঠা আরব জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং উসমানীয় সরকারের প্রতি অনুগত থাকেন। আরব জাতীয়তাবাদ ও ব্রিটিশদের মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তিনি সোচ্চার থাকেন।

১৯১১ সালে ইতালি উসমানিয়দের কাছ থেকে লিবিয়া দখল করলে তিনি এর প্রতিরোধে ভূমিকা রাখেন। তিনি সিরিয়ায় লিবিয়ার যোদ্ধাদের জন্য অর্থ কালেকশন করেন। সামরিক প্রশিক্ষণ আছে এমন স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠিত করে তিনি লিবিয়ায় প্রেরণ করেন।

সিরিয়ায় ফরাসি-বিরোধী প্রতিরোধ:

১৯১৯ সালে ফরাসিরা উত্তর সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবেশ করে। তাদের সহায়তায় প্রথম ফয়সাল স্বাধীন আরব রাষ্ট্র হিসেবে রাজতান্ত্রিক সিরিয়া প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসময় আল-কাসসাম (রহ) এর বাহিনী রাজতন্ত্রের যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তাদেরকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়। তবে ফরাসি সৈন্যরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সংহত করার পর আল-কাসসাম বাহিনীর সাথে তীব্র যুদ্ধ হয়। বছরখানেক ধরে তিনি ফরাসিদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ফরাসিদের অব্যাহত বিজয়ে আল-কাসসাম বাহিনী রসদ সংকটে পড়ে যায়। কোণঠাসা হয়ে আল কাসসাম রহ. সিরিয়া ত্যাগ করেন এবং ফিলিস্তিনে চলে যান।

ফিলিস্তিনে আল কাসসাম (রহ) এর সংগ্রামঃ

সিরিয়াতে বিপর্যন্ত হওয়ার পর আল কাসসাম (রহ) প্রথমে লেবাননের বৈরুতে যান পরে সেখান থেকে ফিলিস্তিনের হাইফাতে যান। তার পরিবারও তার সাথে ফিলিস্তিনে একত্রিত হয়। তিনি ফিলিস্তিনে বসবাস শুরু করেন এবং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা শুরু করেন। এসময় ফিলিস্তিন ব্রিটেনের অধীনে ছিল। তিনি ফিলিস্তিনি মুসলিমদের মধ্যে বিদআতি ও শিরকি কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করেন। তিনি তাদের সঠিক ইসলামের চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেন।
পাশাপাশি আল-কাসসাম (রহ)গরিব মানুষদের নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করেন।তিনি শ্রমিকদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন এবং ইমাম হিসেবে প্রথমে জেরিনি মসজিদ ও পরে ইসতিকলাল মসজিদে তাদের শিক্ষা প্রদান করেছেন।

তিনি ব্রিটিশ ও ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন। সাধারণ ফিলিস্তিনি নেতারা জায়নবাদি বসতিস্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতেন।
কিন্তু আল-কাসসাম রহ. উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াইকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। অধিকাংশ ফিলিস্তিনি নেতা ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের সমর্থক হলেও আল-কাসসাম(রহ) ফিলিস্তিনের সংঘাতকে ধর্মীয় সংগ্রাম হিসেবে দেখতেন। ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসন এবং জায়নবাদিদের আধিপত্য উৎখাতের জন্য আল-কাসসাম রহ.নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক জিহাদের পক্ষে ছিলেন। জিহাদের প্রতি আত্মোৎসর্গের প্রতীক হিসেবে তিনি পুরুষদের দাড়ি রাখা ও সবসময় সঙ্গে কুরআন রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন।
তিনি ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। তার বাধার ফলে ইহুদিরা বসতি স্থাপনে ব্যর্থ হয়। কিছু স্থান থেকে তারা পালিয়ে যায়। ফলে অবধারিতভাবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে তার সংঘর্ষ শুরু হয়।

শাহাদাতঃ-
১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আল কাসসাম রহ.-সহ তাঁর কিছু সহকর্মীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। ফলে আল-কাসসাম ও তাঁর বারোজন অনুসারী আত্মগোপনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা জেনিন ও নাবলুসের মধ্যের পাহাড় দিয়ে হাইফা ত্যাগ করেন। শাইখ জাইদের গ্রামে একটি গুহায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আল-কাসসামকে ঘিরে ফেলে। ২০ নভেম্বর এখানে সংঘটিত দীর্ঘ লড়াইয়ে আল-কাসসাম ও তার তিন অনুসারী নিহত হন এবং পাঁচজন বন্দী হন।

জেরিনি মসজিদে আল-কাসসাম রহ এর জানাজায় প্রচুর মানুষ সমবেত হয়, এদের অধিকাংশ ছিল কৃষক ও শ্রমজীবী। আল-কাসসামের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় হাইফাসহ বেশ কিছু ফিলিস্তিনি ও সিরিয়ান শহরে ধর্মঘট পালিত হয়। আল-কাসসাম রহ.-কে সাবেক ফিলিস্তিনি গ্রাম বালাদ আল-শাইখে দাফন করা হয়। যা এখন ইসরাঈলের শহর নেশ নামে পরিচিত।

তিনিই ফিলিস্তিনের মুজাহিদদের অনুপ্রেরণাঃ

আল কাসসাম রহ. এর সংগ্রাম এখনো চলমান
আল-কাসসামের আন্দোলনের সদস্যরা “কাসসামিয়ুন” নামে পরিচিত ছিল। তার মৃত্যুর পাঁচ মাস পরে তার দলের এক কর্মী ফারহান আল-সাদির নেতৃত্বে দুইজন ইহুদি সন্ত্রাসীকে হত্যা করেন। এটি আরব বিদ্রোহের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কাসসামিয়ুনদের নেতৃত্বে কৃষক ও শহুরে গেরিলারা দেশজুড়ে বিদ্রোহ শুরু করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৯৬০ এর দশকে সৃষ্ট ফিলিস্তিনি ফিদাইন যোদ্ধারা আল-কাসসাম রহ.কে নিজেদের প্রেরণার উৎস হিসেবে দেখত। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র আন্দোলন ফাতাহের প্রতিষ্ঠাতারা প্রথমে নিজেদের দলকে “কাসাসামিয়ুন” বলে ডাকতেন। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জউদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড নিজেদের প্রস্তুতকৃত ও ব্যবহৃত স্বল্পপাল্লার রকেটের নামও কাসসাম রকেট রেখেছে।

মোটকথা ফিলিস্তিনের সকল যোদ্ধাদের কাছেই আল কাসসাম রহ. হলেন প্রতিরোধ আন্দোলনের নায়ক।

আল্লাহ তাআলা যেন শহীদ আল কাসসাম রহ. কে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করেন আর ফিলিস্তিনকে ইহুদিবাদের হিংস্র আর বর্বরতা থেকে রক্ষা করেন।

লেখকঃ
ডাঃ মোঃ মাকসুদ আলম ফাহিম
জেলা ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর
জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন সংস্থা
কলামিস্ট & পাবলিক হেলথ এক্টিভিস্ট।