আনজার আল মুনির : জনাব মোহাম্মদ তাবারক হোসাইন তাঁর রচিত “জকিগঞ্জের ইতিহাস ও সংস্কৃতি” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কিংবদন্তি অনুযায়ী শাহ জাকী নামে একজন পীর কুশিয়ারা নদীর তীরে তাঁর আস্তানা স্থাপন করেছিলেন। এই পীরের আস্তানার আশেপাশে সাপ্তাহিক বাজার বসতো, যা পরবর্তীতে জকিগঞ্জ নামে পরিচিতি পায়। তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, ভরন পরগনার খোদাদাদ তালুক নিলাম গ্রহণকারী সিলেটের মজুমদার পরিবারের গোলাম জাকির স্মরণে জকিগঞ্জ বাজারের নামকরণ হয়েছে—এই দাবি ঠিক নয়। তাঁর মতে, জকিগঞ্জ নামটি সেই পীরের স্মৃতিকে বহন করে, যার প্রমাণ হিসেবে এখনো ‘পীরের খাল’ বিদ্যমান।
অন্যদিকে, জনাব মোঃ আব্দুল খালিক বলেন যে, গোলাম জাকি মজুমদারের নামে জকিগঞ্জ এবং তাঁর ভাই করিম মজুমদারের নামে ভারতের করিমগঞ্জ শহরের নামকরণ হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে “জাকি” অর্থ অশ্বারোহী বা জ্ঞানদাতা। (সূত্র- জনাব মোঃ এখলাছুর রহমান সম্পাদিত “দিবাকর”, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, পৃ. ১০)।
জনাব মৌলানা আবদুল মালিক আরিফের ভাষ্য অনুযায়ী, মাহতাব খানের পুত্র গোলাম জাকি মজুমদার ছিলেন কানুনগো, এবং তাঁর নামেই জকিগঞ্জের নামকরণ হয়েছে। এই বিষয়ে আবুল মুঈদ মজুমদার তাঁর রচিত সিলেটের মজুমদার পরিবারের ইতিহাসে (১৪৬৪-১৯৯১) ভরন সৌদিয়া ওয়াকফ এস্টেট এবং জকিগঞ্জের সংযোগ প্রমাণ করেছেন। তাঁর মতে, মুহাম্মদ আব্দুল করিম চৌধুরীর নামে করিমগঞ্জ শহরের নামকরণ হয়েছিল, এবং করিমগঞ্জের অনেক আগেই জকিগঞ্জের নাম রাখা হয়েছিল।
জনাব মওলানা মোঃ নূরুল ইসলাম, জকিগঞ্জ সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, এই গ্রন্থে জকিগঞ্জের ধর্মীয় অবস্থা বিষয়ক একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, হজরত শাহ জালাল (রহ.)-এর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার তালিকায় ২৫০ নম্বরে হজরত জাকি শেখ (রহ.)-এর নাম রয়েছে। জকিগঞ্জ বাজারের দক্ষিণ পাশে কুশিয়ারা নদীর তীরের একটি মাজারকে অনেকে জাকী শেখের রওজা মনে করেন। কেউ কেউ বলেন, এটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে এবং এই পীরের নাম অনুসারেই জকিগঞ্জের নামকরণ হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ফার্সি “গঞ্জ” শব্দটির অর্থ বাজার, আগে “জাকীগঞ্জ” লেখা হতো এবং ইংরেজিতে “ZAKI” লেখা হয়, যা জাকী শেখের নামের উচ্চারণের সাথে মিলে যায়।
এই পুস্তক রচনার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে প্রবীণ ও মুরব্বীদের সাথে সভা করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের মুরব্বীদের মতে, জকিগঞ্জ নামটি মূলত জাকী শেখের নাম অনুসারেই হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, জকিগঞ্জ বাজারটি পীরের খালের মোহনায় অবস্থিত ছিল, যা পরবর্তীতে ভরাট হয়ে বাজার গড়ে ওঠে। এছাড়া, জকিগঞ্জ বাজারের একটি অংশের নাম “পীরের চক”। এই ইতিহাস থেকে বোঝা যায় যে, জাকী শেখের আগমনের কারণেই জকিগঞ্জের নামকরণ সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছে।
১৯৪৭ সালের আগে “জকিগঞ্জ” বলতে শুধুমাত্র বর্তমানের জকিগঞ্জ বাজারকেই বোঝাতো; আলাদা কোনো প্রশাসনিক ইউনিট ছিল না। জকিগঞ্জের বর্তমান এলাকা করিমগঞ্জ সদর থানার অধীনে ছিল। দেশ বিভাগের সময়, করিমগঞ্জের যে অংশ বর্তমান বাংলাদেশের অংশে এসেছিল, সেই অংশটি জকিগঞ্জ নামে প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে ঘোষিত হয়। বর্তমানে, জকিগঞ্জ একটি উপজেলা হিসেবে পরিচিত, যেখানে ৯টি ইউনিয়ন রয়েছে।
তথ্যসূত্র: প্রসঙ্গ জকিগঞ্জ: ইতিহাস ও ঐতিহ্য। লেখক: মোহাম্মদ হান্নান মিয়া।