আনজার আল মুনির: বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান প্রসার এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা আজ বৈশ্বিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশও এ পরিবর্তনের বাইরে নয়। দেশের ই-কমার্স খাত এক নতুন বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে, যা ব্যবসার ধরণ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পর্যন্ত সবকিছুকে বদলে দিতে পারে।
ই–কমার্সের বর্তমান প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে ই-কমার্সের যাত্রা শুরু হয় প্রায় এক দশক আগে। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে এটি সীমিত পরিসরে পরিচালিত হতো, কিন্তু মোবাইল ইন্টারনেট, স্মার্টফোন এবং মোবাইল ব্যাংকিং সেবার প্রসার ই-কমার্স খাতকে অনেক এগিয়ে নিয়েছে।
২০১৮ সালের পর ই-কমার্স খাত ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় এটি একটি জীবনরক্ষাকারী প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়, যখন মানুষ ঘরে বসে প্রয়োজনীয় পণ্য কেনা-বেচা করছিল। BASIS (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস) এর তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারের আকার প্রায় ৩৫০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
দারাজ, রকমারি, শপআপ এবং ফেসবুক মার্কেটপ্লেসের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো বর্তমানে ই-কমার্স খাতের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি, ছোট উদ্যোক্তারা ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সরাসরি তাদের পণ্য বিক্রি করছেন।
ই–কমার্স কীভাবে ভবিষ্যৎ ব্যবসার বিপ্লব ঘটাবে
১. বাজারের পরিসর বৃদ্ধি
ই-কমার্স ব্যবসা ভৌগোলিক সীমার বাইরে গিয়ে নতুন বাজার তৈরির সুযোগ দিচ্ছে। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা স্থানীয় বাজারের চেয়ে বড় পরিসরে পণ্য সরবরাহের সুযোগ পাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম কিংবা যশোরের হস্তশিল্প এখন দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে।
২. উদ্যোক্তাদের নতুন দিগন্ত
ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এটি একটি আশীর্বাদস্বরূপ। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রায় ৬০% নারী, যারা ফেসবুক ও অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করছেন। এটি শুধু তাদের আর্থিক স্বাধীনতাই নয়, সামাজিক অবস্থানের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে।
৩. কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র
ই-কমার্স খাত সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে। সরাসরি কর্মসংস্থানের মধ্যে রয়েছে পণ্য প্যাকেজিং, লজিস্টিক সেবা, এবং আইটি সাপোর্ট। পাশাপাশি, পরোক্ষ কর্মসংস্থানের মধ্যে রয়েছে গ্রামীণ উৎপাদক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, এবং পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।
৪. প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি
বিগ ডাটা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI), এবং ক্লাউড কম্পিউটিং প্রযুক্তি ই-কমার্স খাতকে আরও কার্যকর ও গ্রাহকবান্ধব করে তুলছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো কাস্টমারদের চাহিদা বিশ্লেষণ এবং কেনাকাটার অভিজ্ঞতা আরও সহজ করতে পারছে।
৫. রপ্তানি বাজারের প্রসার
ই-কমার্স বাংলাদেশে রপ্তানি ব্যবসার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। দেশীয় পণ্য, যেমন জামদানি শাড়ি, নকশিকাঁথা, এবং হস্তশিল্প এখন আমাজন, ইবে এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ICT Division-এর তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ই-কমার্স রপ্তানির আয় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে।
৬. ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের প্রসার
ই-কমার্সের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিং এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সেবার ব্যবহারও বাড়ছে। বিকাশ, নগদ, এবং রকেটের মতো সেবা ক্রেতা এবং বিক্রেতাদের জন্য সহজ এবং নিরাপদ লেনদেন নিশ্চিত করছে।
চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাব্য সমাধান
ই-কমার্স খাতের অগ্রগতি হলেও কিছু বাধা এখনও বিদ্যমান।
চ্যালেঞ্জ:
- ডেলিভারি এবং লজিস্টিক সমস্যা: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডেলিভারি ব্যবস্থা এখনও অপ্রতুল।
- বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব: পণ্য ও সেবার মান নিয়ে ক্রেতাদের অনেক প্রশ্ন থাকে।
- ডিজিটাল দক্ষতার ঘাটতি: অনেক ছোট ব্যবসায়ী এবং ক্রেতারা ই-কমার্স ব্যবস্থায় দক্ষ নন।
সমাধান:
- ডেলিভারি নেটওয়ার্ককে আরও শক্তিশালী করতে সরকারের সহযোগিতা এবং লজিস্টিক সেবাদাতাদের উন্নয়ন করতে হবে।
- কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন এবং গ্রাহক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
- উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত দেশের জিডিপি’র ৫% অবদান রাখতে সক্ষম হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগ এবং তরুণ প্রজন্মের প্রযুক্তি গ্রহণের প্রবণতা ই-কমার্স খাতকে আরও এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত কেবলমাত্র ব্যবসার ধরন বদলে দিচ্ছে না, বরং এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন পথ উন্মুক্ত করছে। গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, এবং তরুণদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে ই-কমার্স আগামী দিনের ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে। সঠিক পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে ই-কমার্স বাংলাদেশে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করবে।
তথ্যসূত্র:
- বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (BASIS)।
- ICT Division Bangladesh।
- “ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা,” দ্য ডেইলি স্টার, ২০২৩।
- “ডিজিটাল বাংলাদেশে ই-কমার্সের প্রভাব,” প্রথম আলো, ২০২৪।
লেখক- নির্বাহী সম্পাদক, ডেইলি জকিগঞ্জ
ref:anj231124/1